সুস্থায়ী কৃষি: প্রধান উদ্ভিদ পেস্ট ও রোগসমূহ এবং তাদের দমন

প্রধান কয়েকটি রোগের রোগ সৃষ্টিকারী জীবের নাম, রোগ লক্ষণ, ও রোগ দমন সম্বন্ধে আলোচনা কর।অথবা, শস্যের বিবিধ রোগ এবং তাদের প্রতিকার পদ্ধতি সম্বন্ধে আলোচনা কর।সুসংহত পেস্ট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর।

প্রধান উদ্ভিদ রোগসমূহ এবং তাদের দমন

প্রধান কয়েকটি রোগের রোগ সৃষ্টিকারী জীবের নাম, রোগ লক্ষণ, ও রোগ দমন সম্বন্ধে আলোচনা কর।অথবা, শস্যের বিবিধ রোগ এবং তাদের প্রতিকার পদ্ধতি সম্বন্ধে আলোচনা কর।

১. ধান গাছের বাদামী রোগ বা স্পট রোগ :-

এই রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু হলো Helminthosporium oryzae নামক ছত্রাক।

(ক) রোগ লক্ষণ :- পোষক দেহের রোগাক্রান্ত স্থান কৌণিক বা গোলাকার দাগের সৃষ্টি করে। আক্রান্ত অংশের কলাগুলি পিঙ্গল বর্ণ ধারণ করে, তাই এরকম দাগ দেখা দেয়। পাতা শুকিয়ে যায়। পুষ্পমঞ্জরী ও বীজেও একই রকম দাগ সৃষ্টি হয়। 

(খ) রোগ দমন :- ছত্রাক নাশক ওষুধ বিশেষ করে বোর্দো মিশ্রণ তিন চারবার সিঞ্চন করতে হবে। অথবা 0.2% ডাইথেন Z-78 বা 1% পারদ সমন্বিত পারদঘটিত জৈব ছত্রাকনাশক চূর্ণ রোগাক্রান্ত উদ্ভিদ দেহে সিঞ্চন করতে হবে।

২. পাট গাছের কান্ডের পচন রোগ :-

এই রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু হল Macro-phomina phaseoli নামক ছত্রাক।

(ক) রোগ লক্ষণ :- পাট গাছের বিভিন্ন অংশে কৃষ্ণাঙ্গ পিঙ্গল বর্ণের দাগ দেখা যায়। যেমন – বীজপত্র, কান্ড, পাতা, ফল ইত্যাদি।

(খ) রোগ দমন :- ছত্রাক নাশক বিশেষ করে বোর্দো মিশ্রণ সিঞ্চন করলে উপকার পাওয়া যায়। অ্যাগ্রোমান GN, সেরেমান ইত্যাদি জৈব পারদঘটিত যৌগ দিয়ে বীজ শোধন করা প্রয়োজন।

৩. আলুর ধসা রোগ :-

এই রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু হলো Phytophthora infestans নামক ছত্রাক।

(ক) রোগ লক্ষণ :-

  • (i) পাতার কিনারা ও অগ্রপ্রান্তে কালো বর্ণের ক্ষুদ্র গোলাকার দাগ দেখা যায়।
  • (ii) কান্ড কালো হয় এবং কুঁচকে যায়।
  • (iii) স্ফীত কন্দে অর্থাৎ আলুর ওপর বাদামী দাগ দেখা যায় এবং আলো দ্রুত পচে যেতে থাকে।

(খ) রোগ দমন :-

  • (i) রোগ মুক্ত বীজের ব্যবহার। 
  • (ii) নাইট্রোজেন যুক্ত সারের ব্যবহার।
  • (iii) ছত্রাক নাশক ওষুধ ডাইথেন M45, ডাইথেন Z-78, ফাইটোলন প্রভৃতি স্প্রে করা দরকার।

৪. গম গাছের কৃষ্ণ বর্ণের মরিচা রোগ :-

এই রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু হলো Puccinia graminis নামক ছত্রাক। 

(ক) রোগ লক্ষণ :-

  • (i) গম গাছের কান্ড ও পাতায় বাদামী রঙের দাগ দেখা যায়।
  • (ii) মঞ্জরি শিষ উৎপন্ন হলে সেখানে বাদামী রঙের স্ফীতি দেখা যায়। 
  • (iii) বাদামি বর্ণ ধীরে ধীরে কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করে। 
  • (iv) গমের শস্য দানা কুঞ্চিত ও হালকা হয়।

(খ) রোগ দমন :-

  • (i) রোগ প্রতিরোধী বীজ বপন। যেমন – N P770, 802, 829, Hy-65, ফারমা রোজেন ইত্যাদি।
  • (ii) নাইট্রোজেন ঘটিত সার প্রয়োগ।
  • (iii) রাসায়নিক যৌগ, যেমন – একর প্রতি জমিতে 6.7-9.0 কেজি গন্ধক চূর্ণ প্রয়োগ করলে বা 450 লিটার জলে 336 গ্রাম জিংক সালফেট গুলে সিঞ্চন করলে এই রোগের হাত থেকে ফসলকে রক্ষা করা যায়।

৫. গম গাছের লুজ স্মার্ট রোগ :-

এই রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু হলো Ustilago tritici নামক ছত্রাক।

(ক) রোগ লক্ষণ :-

  • (i) পুষ্প মঞ্জরি গুলি কালো বা জলপাই বর্ণ ধারণ করে।
  • (ii) কিছুদিন পর অনুমঞ্জরি গুলি ঝরে পড়ে ফলে নগ্ন অক্ষ সৃষ্টি হয়।

(খ) রোগ দমন :-

  • (i) শোধন করা বীজ বপন।
  • (ii) রোগ প্রতিরোধক্ষম বীজ বপন।
  • (iii) প্রতি কেজি গম বীজকে 2.5 গ্রাম ভিটাভ্যাক্স বা বেনলেট দ্বারা শোধন করলে রোগ দমনে সুফল পাওয়া যায়।

৬. চা গাছের ধূসর ধসা রোগ :-

এই রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু হলো Pestalotia ফানজাই ইমপারফেকটি। 

(ক) রোগ লক্ষণ :-

  • (i) প্রথমে পাতার উপরিতলে বাদামি বর্ণের অসংখ্য বিন্দুর মতো দাগ সৃষ্টি হয়।
  • (ii) দাগগুলি পরস্পর জুড়ে পাতার সমস্ত ফলককে ঢেকে ফেলে।
  • (iii) এরপর পাতার নিম্নতলেও অনুরূপ দাগ সৃষ্টি হয়।
  • (iv) পাতায় আক্রান্ত অংশগুলি ভেঙে যায় এবং ঝরে পড়ে।

(খ) রোগ দমন :-

  • (i) আক্রান্ত স্থানের ডালপালা ছেঁটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
  • (ii) শীতকালে একবার এবং চৈত্র-বৈশাখ মাসে ডাল ছাঁটার পর একবার বোর্দো মিশ্রণ সিঞ্চন করলে সুফল পাওয়া যায়।

৭. লিচুর ব্রাউন ব্লাইট রোগ :-

এই রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু হলো theae Peronophythora litchii নামক ছত্রাক।

(ক) রোগ লক্ষণ :- এই ছত্রাক লিচু ফলকে আক্রমণ করে, ফলে লিচুর রং বাদামি বর্ণ ধারণ করে।

(খ) রোগ দমন :-

  • (i) গাছের আক্রান্ত ছাল, ডালপালা এবং আক্রান্ত ফল সরিয়ে ফেলতে হবে।
  • (ii) শীতকালে কপার অক্সিক্লোরাইড এবং বসন্তকালে কপার সালফেট স্প্রে করলে এই ছত্রাক ধ্বংস হয়।

প্রধান উদ্ভিদ পেস্ট সমূহ এবং তাদের দমন

সুসংহত পেস্ট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর।

সুসংহত পেস্ট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা :-

যে পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ মাত্রায় রাসায়নিক ও কীটনাশক ব্যবহারের সঙ্গে যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, জৈব নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি অবলম্বন করে পেস্ট দমন করা হয় তাকে সুসংগত বেস্ট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বলে।

সুসংহত পেস্ট নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি :-

সুসংহত পেস্ট নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির বিভিন্ন দিকগুলি হল –

  • (ক) পেস্ট বা কীটপতঙ্গের খাদক শ্রেণীর ব্যবহার :- এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন প্রকার বন্ধু পোকা, যেমন- মাকড়সা, লেডি বিটল, পিঁপড়ে, বোলতা ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। এরা সরাসরি খাদ্য হিসেবে শত্রু পোকার উপর ডিম পেড়ে বা কিছু বিষাক্ত পদার্থ বের করে ক্ষতিকারক রোগজীবাণু বা পোকাকে ধ্বংস করে।
  • (খ) জৈবিক পদ্ধতি :- পেস্ট গোত্রীয় জীবকে অপর কোনো জীব দ্বারা দমন করা হলে তাকে জৈবিক পদ্ধতিতে পেস্ট দমন বলে। যেমন – ইঁদুর ও অন্যান্য রোডেন্ট পেস্টের দমনের জন্য বিড়াল, সাপ, চিল প্রভৃতি অন্যান্য প্রাণীর সাহায্য নেওয়া হয়।
  • (গ) রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার বন্ধ করা :- পেস্ট দমনের জন্য রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। যদি সম্ভব হয় রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে দেওয়া বা বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
  • (ঘ) যান্ত্রিক উপায়ে নিয়ন্ত্রণ :- শস্য ক্ষেত্রে বিশেষ পেস্টের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ফাঁদে ফেলে পেস্ট ধরে ফেলা যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পেস্ট দমনের অন্তর্গত।
  • (ঙ) আধুনিক চাষ পদ্ধতি :- বর্তমানে পেস্ট নিয়ন্ত্রণের জন্য আধুনিক কৃষি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। এক্ষেত্রে সুস্থ বীজের ব্যবহার, জৈব সারের ব্যবহার এবং নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশ সারের সুষম প্রয়োগ শষ্যক্ষেত্রে পেস্ট দমনে সাহায্য করে।

Leave a Comment