সুস্থায়ী কৃষি পদ্ধতির কর্ম পরিকল্পনা

সুস্থায়ী কৃষি পদ্ধতির কর্ম পরিকল্পনা বিষয়ে আলোচনা করা হল – সুস্থায়ী কৃষি ব্যবস্থাপনা কিভাবে সম্ভব হতে পারে? অথবা, সুস্থায়ী কৃষির প্রধান ভিত্তি গুলি আলোচনা কর।এবং সুস্থায়ী কৃষি কর্ম পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা করা হল।

সুস্থায়ী কৃষি পদ্ধতির কর্ম পরিকল্পনা বিষয়ে এই দুটি প্রশ্ন আলোচনা করা হল-

  • প্রশ্ন-১: সুস্থায়ী কৃষি ব্যবস্থাপনা কিভাবে সম্ভব হতে পারে? অথবা, সুস্থায়ী কৃষির প্রধান ভিত্তি গুলি আলোচনা কর।
  • প্রশ্ন-2: সুস্থায়ী কৃষি কর্ম পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা কর।

Table of Contents

সুস্থায়ী কৃষি পদ্ধতির কর্ম পরিকল্পনা


প্রশ্ন-১: সুস্থায়ী কৃষি ব্যবস্থাপনা কিভাবে সম্ভব হতে পারে? অথবা, সুস্থায়ী কৃষির প্রধান ভিত্তিগুলি আলোচনা কর।

সুস্থায়ী কৃষি পদ্ধতি প্রধানত তিনটি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে গঠিত। এগুলি হল –

  • (ক) বাস্তুতান্ত্রিক উন্নয়ন,
  • (খ) অর্থনৈতিক সুস্থিরতা
  • (গ) সামাজিক সুস্থিরতা।

(ক) বাস্তুতান্ত্রিক উন্নয়ন :-

বর্তমান খামারগুলি কৃষিক্ষেত্রে বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্যকে মাথায় না রেখে অত্যধিক শস্য উৎপাদনের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে জমির উর্বরতাকে বিনষ্ট করে। তারা বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্যকে নষ্ট করে। সুস্থায়ী কৃষির চিন্তাধারা কৃষিক্ষেত্রে এই সকল সমস্যাগুলির সুষ্ঠু সমাধান করতে সক্ষম হবে এবং বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্যকে বিঘ্নিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করবে।

  • (i) মৃত্তিকার উর্বরতা বৃদ্ধি :- ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থার প্রধান সমস্যা অনুর্বর মৃত্তিকা। মৃত্তিকার এই অনুর্বরতা প্রধানত অত্যধিক ফলন, উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যাপকহারে ব্যবহার, রাসায়নিক সার প্রয়োগ ইত্যাদির জন্য হয়ে থাকে। সুস্থায়ী কৃষি এই সকল সমস্যাগুলির সুষ্ঠু সমাধানে সক্ষম।
  • (ii) জল :- বর্তমানে কৃষিতে সার, কীটনাশক ইত্যাদি উপাদানগুলি ব্যবহারের জন্য অত্যধিক জলের প্রয়োজন হয়। ফলে জলসেচ ব্যবস্থা যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ ও চাষের ব্যয়ের ওপর চাপ বৃদ্ধি করে। সুস্থায়ী কৃষি জমির উপরিস্তরের মৃত্তিকায় বৃষ্টির জলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। এর ফলে জলের অভাবমোচন হয় ও অতিরিক্ত জলের প্রয়োজন মেটানো যায়।
  • (iii) জীববৈচিত্র্য :-সুস্থায়ী কৃষি হল নিয়মিত কৃষি পদ্ধতি এবং এতে মিশ্র শস্যের চাষও হয়, তার ফলে কৃষিজমিতে শস্যের পাশাপাশি অন্যান্য উদ্ভিদের জন্ম ও বৈচিত্র্য দেখা যায়। নতুন নতুন প্রজাতির কীটপতঙ্গের আগমনের ফলে জীববৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়।
  • (iv) দূষণ :-কীটনাশকের অত্যধিক ব্যবহার দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি করে। পরোক্ষভাবে যা মানুষের নানা শারীরিক গোলযোগের সৃষ্টি করে। সুস্থায়ী কৃষি এই সকল রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং প্রাকৃতিক সারের ও উন্নত কীটনাশকের ব্যবহার করে জমির দূষণকে নিয়ন্ত্রণ করে।
  • (v) ভূমিরূপ :-গ্রামের পরিবেশ কৃষি ও বনাঞ্চল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং ভূমিভাগ শস্য দ্বারা আবৃত থাকে। জমির অধিক ব্যবহার ভূমিধ্বস ও বন্যার সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলে সেই স্থান মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে ওঠে। ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রামাঞ্চলগুলির উন্নয়নের জন্য অর্থ ব্যয় হয় এবং তা পুনরায় বসবাসের উপযোগী করে তুলতে অনেক সময় লাগে। সুস্থায়ী কৃষি উপরোক্ত সমস্যাগুলি থেকে রক্ষা করে উৎপাদন বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে, মৃত্তিকা সংরক্ষণ করে এবং সঠিক পদ্ধতিতে চাষ-আবাদ করে। ফলে গ্রামের মানুষকে শহরাঞ্চলে কর্মসন্ধানে আসতে হয় না। 
  • (vi) জলবায়ু :-অনিয়ন্ত্রিত এই কৃষি ব্যবস্থা সমগ্র বিশ্বের জলবায়ুর পরিবর্তন করতে পারে। কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন ঘটে এবং তার পরিমাণকে বৃদ্ধি করে। উদ্ভিদের কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণের পরিমাণকে কমিয়ে দেয়। সুস্থায়ী কৃষির সাহায্যে উক্ত সমস্যাগুলির সঠিক সমাধান করা সম্ভব হয়।

(খ) অর্থনৈতিক সুস্থিরতা :-

  • (i) মানুষের অভ্যন্তরীণ চাহিদার কথা মাথায় না রেখে শুধুমাত্র উদ্‌বৃত্তের তাগিদে বর্তমানে সরকারও কৃষিকার্য করতে বাধ্য করে। পরিণতিরূপে সঠিক সময়ে ঋণের অর্থ ফেরত না দিতে পেরে চাষিরা আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
  • (ii) জৈব কৃষিব্যবস্থা সাধারণ কৃষিব্যবস্থার তুলনায় অনেক বেশি উন্নত এবং নিয়ন্ত্রিত। তাই জৈব উপায়ে সুস্থায়ী পদ্ধতির কৃষিকাজ করা একান্ত প্রয়োজন।
  • (iii) কৃষিকাজ একটি প্রাথমিক কর্ম যা গ্রামাঞ্চলের নারী, পুরুষেরা সম্পাদন করে থাকে। একটি জমিকে চাষ করতে যে কয়জন ব্যক্তির প্রয়োজন হয় তার চেয়ে বেশি মানুষ উক্ত জমিতে কাজ করে। এজন্য কর্মক্ষম ব্যক্তির গণনার ক্ষেত্রে একটি সমস্যার সৃষ্টি হয়।

(গ) সামাজিক সুস্থিরতা :-

  • (i) সুস্থায়ী কৃষি ব্যবস্থায় কৃষিতে নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গের কর্মসংস্থান হয়। এর ফলে গ্রামাঞ্চলে মহিলা, পুরুষ উভয়ে কর্মমুখী হয়ে ওঠে।
  • (ii) সুস্থায়ী কৃষি জাতি উপজাতির আদিম সত্তাকে বহাল রাখে। এই কৃষি ব্যবস্থায় বিভিন্ন জাতির অভ্যন্তরীণ শ্রদ্ধা অব্যাহত থাকে। তারা তাদের প্রাচীন বিধিনিষেধকে বজায় রেখে কৃষিকার্য
  • (iii) সুস্থায়ী কৃষি ব্যবস্থা কৃষির প্রাচীনত্বকে ভেঙে আধুনিকতাকে বজায় রাখে। এর ফলে পুরুষ, মহিলা, উচ্চ-নীচ সকলে একত্রে কাজ করায় মেলামেশার সুযোগ অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
  • (iv) জমির উর্বরতাকে সক্ষম রেখে, জনসংখ্যার প্রয়োজনকে সম্পূর্ণ করে এই কৃষি ব্যবস্থা চালু থাকায় জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আবার মানুষের মেলামেশার বৃদ্ধি হওয়ায় সংস্কৃতির আদানপ্রদান ও কৃষিক্ষেত্রে নতুনত্বের সম্ভাবনা বেড়েছে।

প্রশ্ন-2: সুস্থায়ী কৃষি পদ্ধতির কর্ম পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা কর।

সুস্থায়ী কৃষি ব্যবস্থা কাকে বলে?

যে কৃষি ব্যবস্থা জৈবিক পদ্ধতিতে হয়, যা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যোগ্য, পরিবেশ বান্ধব সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য তাকে সুস্থায়ী কৃষি ব্যবস্থা বলা হয়।

সুস্থায়ী কৃষি পদ্ধতির কর্ম পরিকল্পনা বা কার্যাবলী

সুস্থায়ী উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে সুস্থায়ী কৃষি সম্পর্কিত নানান গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী সম্পন্ন করা হয়। এই সকল কার্যাবলী হল –

শস্য চাষের জন্য মৃত্তিকার নিঃশেষিত হওয়া পুষ্টির পূরণ :-

মৃত্তিকা মধ্যস্থ বিভিন্ন প্রকার খনিজ পদার্থ এবং অজৈব লবনের উপস্থিতিতে ক্রমাগত শস্য চাষ করার ফলে তাদের মাত্রার ক্ষয় ঘটছে। বিভিন্ন প্রকার শস্য চাষের মধ্যে বিরতি রেখে মৃত্তিকা উপযোগী নানান জৈব সার এবং বর্তমানে ব্যবহৃত জৈব প্রযুক্তি প্রয়োগ করে সেই নিঃশেষিত পুষ্টির মাত্র পূরণ করা সম্ভব।

মৃত্তিকার ভৌত অবস্থা বজায় :-

সুস্থায়ী কৃষি কর্ম পরিকল্পনার উদ্দেশ্য মৃত্তিকাস্থিত নানান ভৌত উপাদান, যেমন – মাটির কণা, জল, বায়ু এবং মৃত্তিকা মধ্যস্থ বিভিন্ন জীব প্রভৃতির মাত্রা সুসামঞ্জস্য ভাবে বজায় রাখা উচিত।

মৃত্তিকাস্থিত জৈব পদার্থের মাত্রা বৃদ্ধি ও নিয়ন্ত্রণ :-

মৃত্তিকার মধ্যে বিভিন্ন প্রকার জৈব পদার্থ মিশে থাকে, যেমন – প্রাণীদের মলমূত্র, মৃত দেহাবশেষ ইত্যাদি। অধিক জৈব পদার্থ মিশ্রিত মাটিকে হিউমাস বলা হয়। হিউমাস যুক্ত মৃত্তিকা কৃষিকাজে উর্বর হয়। সেই জন্য মৃত্তিকাস্থিত জৈব পদার্থের মাত্রা বৃদ্ধি ও সেই সঙ্গে অতিরিক্ত মাত্রা যাতে না হয় সেদিকেও নজর রাখা উচিত।

আগাছা নির্মূল করন ও পেস্ট দমন :-

সুস্থায়ী কৃষি উন্নয়নের স্বার্থে জৈব কীটনাশক প্রয়োগ করে ক্ষতিকর কীট পোকা দমন করে রোগের হাত থেকে শস্য উদ্ভিদ রক্ষা করা দরকার। আগাছা দমনের জন্য আগাছা নাশক (2,4-D) এবং পেস্ট দমনের জন্য পেস্ট নাশক (DDT, BHC, এনড্রিন, প্যারাথিয়ন) ব্যবহার করা হয়।

মৃত্তিকার অমলত্ব ও বিষাক্ত পদার্থের কৃষি নিয়ন্ত্রণ :-

মৃত্তিকার মধ্যে বিভিন্ন প্রকার খনিজ পদার্থ, যেমন – Ca, K, Na, Mg, Fe, P, B, Cu, Mn, Zn প্রভৃতি থাকে। তার সঙ্গে বিভিন্ন অজৈব লবণ, যেমন – সালফেট, ফসফেট, ক্লোরাইড, কার্বনেট ইত্যাদি থাকে। যাদের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে মৃত্তিকাস্থিত অম্লত্বের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

ভূমিক্ষয় নিয়ন্ত্রণ :-

অত্যধিক বৃষ্টিপাতের ফলে জলোচ্ছ্বাসের কারণে ভূমির অবক্ষয় লক্ষ্য করা যায়। সেজন্য অতিরিক্ত জল বাঁধ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে করে ভূমিক্ষয় রোধ করতে হবে। এছাড়া বৃক্ষরোপণের মাধ্যমেও ভূমিক্ষয় নিবারণ করা যেতে পারে।

বন্য প্রাণীর যথাযোগ্য বাসভূমির ব্যবস্থাপনা :-

বর্তমানে বন্যপ্রাণীদের যোগ্য বাসস্থানের অভাবে তারা কৃষিক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। ফলে শস্যের অবাধ ক্ষতিসাধন ঘটছে। সুস্থায়ী মূলক কৃষি উন্নয়নের জন্য কৃষি ক্ষেত্রের বাইরের সকল প্রকার সুবিধা সম্পন্ন বন্যপ্রাণীদের জন্য যথাযোগ্য বাসভূমি নির্মাণ করা আবশ্যক।

জিনগত সম্পদের আহরণ ও সংরক্ষণ :-

বর্তমান বৈজ্ঞানিক যুগে আদর্শ জৈব প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নানান জিনগত সম্পদের আহরণ ও তাদের সংরক্ষণ করা আবশ্যক। কারণ ওই সকল সম্পদের ব্যবহার সুস্থায়ী কৃষিকাজে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে।

সুস্থায়ী কৃষি অর্থনৈতিক সাপেক্ষে দেশের সুস্থায়ী উন্নয়নে সহায়ক। সেই জন্য পরিবেশগত বিপন্নতা বা জিনগত বৈচিত্রতা হ্রাস অথবা মৃত্তিকা জনিত উর্বরতা হ্রাস প্রভৃতি সমস্যার জন্য কৃষিতে নানান প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার জন্য বিকল্প প্রযুক্তিবিদ্যা সহায়ক কৃষি ব্যবস্থার কথা ভাবা হচ্ছে, যা সুস্থায়ী কৃষি সম্পর্কিত কর্মপরিকল্পনার আদর্শ হাতিয়ার।

Leave a Comment