সুস্থায়ী কৃষি-পরিবেশ শিক্ষা চতুর্থ অধ্যায় সম্পর্কে আলোচনা করা হল । এই সুস্থায়ী কৃষি অধ্যায় হতে প্রশ্ন ও উত্তরের লিংক দেওয়া হল।
সুস্থায়ী কৃষি পরিবেশ শিক্ষা চতুর্থ অধ্যায়
- (i) ভূমিকা
- (ii) সবুজ বিপ্লব
- (iii) সুস্থায়ী কৃষির প্রয়োজনীয়তা
- (iv) ফসল উৎপাদনে মাটির গুরুত্ব
- (v) জলসেচ ব্যবস্থা ও বিভিন্ন সারের ব্যবহার
- (vi) প্রধান উদ্ভিদ পেস্ট ও রোগসমূহ এবং তাদের দমন ও কৃষি রাসায়নিক – শস্য রক্ষা
- (vii) পরিবেশের উপর কৃষিজ রাসায়নিকের প্রভাব
- (viii) সুস্থায়ী কৃষির উপাদান সমূহ
- (ix) সুস্থায়ী কৃষি পদ্ধতির কর্ম পরিকল্পনা
ভূমিকা :- মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় তিনটি উপাদানকে অগ্রাহ্য করা যায় না। এগুলি হল খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসস্থান। খাদ্যের সংস্থানের জন্য মানুষকে কৃষিকার্যের উপর নির্ভর করতে হয়। আদিম প্রবৃত্তিতে কৃষিকাজ ছিল শ্রমনির্ভর নিত্য তাগিদ কিন্তু বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে মানুষকে উদ্বৃত্তের উপর জোর দিতে হয়। বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন তথা প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল মানুষ তাই কৃষিতে আধুনিকতা আনতে চেষ্টা করে। বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করে কৃষিজ ফলনের পরিমাণ। উন্নত বীজ, উচ্চ রাসায়নিক সার, কীটনাশক, জৈবসার ইত্যাদি ব্যবহার করে ফলন বৃদ্ধি করা এবং একই জমিতে বারংবার ফসল প্রাপ্তির আশা বাড়তে থাকে মানুষের মধ্যে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার জন্য খাদ্যের জোগান বৃদ্ধির তাগিদে মানুষ জমির ওপর চাপ বৃদ্ধি করতে থাকে। জমি তার বহনক্ষমতা ও উর্বরতা হারাতে শুরু করে এবং সহজেই চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ে।
বর্তমানে চাহিদা মিটিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খাদ্যের জোগানকে নিশ্চিত করাই হল সুস্থায়ী কৃষির মূল লক্ষ্য। তাই বিজ্ঞানীদের মধ্যে এই বিষয়ে আলাপ-আলোচনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রতিবছর পৃথিবীর ৮০ লক্ষ হেক্টর চাষযোগ্য জমি চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। বহু লক্ষ জমি ভূমিক্ষয়ের কবলে পর্যবসিত হচ্ছে এবং ৪০ লক্ষ হেক্টর জমি প্রায় মরুভূমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। কৃষিতে বিভিন্ন রাসায়নিক সারের প্রয়োগ ফসলের গুণগত মান অনেকাংশে বিনষ্ট করছে। বীজবপনের মধ্য দিয়ে চাষ ব্যবস্থার শুরু এবং ফসল তোলা অবধি যে পর্যায়গুলি রয়েছে তার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত উপাদানগুলি চাষের ক্ষেত্রে অনেকাংশে ক্ষতিকারক। ফসলকে কীটপতঙ্গের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত কীটনাশক ফসলের মান অনেকাংশে কমিয়ে দেয়, কারণ কীটনাশক গুলি বেশির ভাগ বিষক্রিয়া ঘটায় এবং মনুষ্য শরীরের অনুপযোগী হয়ে ওঠে। জমিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন পদার্থ জমির উর্বরতা শক্তিকে হ্রাস করে এবং জমির গুণগত মান নষ্ট করে। একটি উর্বর কৃষিযোগ্য জমি অত্যধিক রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে হয়ে ওঠে অনুর্বর। যে জমিতে বছরে দুই কিংবা তিনবার ফসল ফলানো সম্ভব হত তাতে একবারের অধিক ফসল ফলানো যায় না। তাই বিজ্ঞানী মহলের কপালে কুঞ্চনের চিহ্ন দেখা দিচ্ছে, কৃষিক্ষেত্র তথা ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি ও তার গুণগত মান বজায় রাখার উদ্দেশ্যে কী উপায় বের করা যায় সে বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে।
বননিধন কৃষি ব্যবস্থাকে আরও বেশি পরিমাণে অনুন্নত তথা অস্থায়ী করে তোলে। বিভিন্ন অঞ্চলের আদিম নিবাসী দ্বারা অনুষ্ঠিত ঝুমচাষ জমির উর্বরতা শক্তিকে বিনষ্ট করছে। শুধু তাই নয়, জমিকে কৃষিকাজের অনুপযোগী করে তুলছে। ভারতের উত্তর-পূর্ব পাহাড়ি অঞ্চলে এই প্রভাব সবথেকে বেশি দেখা যায় কারণ এই সমস্ত অঞ্চলে জমিকে তারা পুড়িয়ে বনাঞ্চল ধ্বংস করে চাষযোগ্য জমি বের করে এবং চাষ আবাদের কিছুদিন পরে অব্যবহৃত অবস্থায় জমিকে পরিত্যক্ত ফেলে অন্যত্র চলে যায়। তার ফলে জমির মান নিম্নমুখী হয় এবং সেই জমি পরবর্তী ব্যবহারের উপযোগী থাকে না। ফসলের উৎপাদন অত্যধিক বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত উচ্চফলনশীল ও সংকর জাতের বীজ ফসলের জিনগত গুণমানের অবলুপ্তি ঘটায় ও বংশগতির অবক্ষয় ঘটায়। কৃষিক্ষেত্রে উক্ত সমস্যাগুলির সঠিক সমাধান বিষয়ে সারা পৃথিবীতে এক সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলাফল বিষয়ে অবগত হয়ে বিজ্ঞানী মহল সুস্থায়ী কৃষির প্রতি নজর দিয়েছেন।
প্রাকৃতিক সম্পদ প্রাপ্ত বিভিন্ন উৎপাদনগুলির প্রতি এর বহু পূর্বেই দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। বনাঞ্চল সংরক্ষণ, মৎস্য চাষ ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলিতে বহু পূর্ব থেকেই সংরক্ষণের ও সুস্থায়িত্বকে প্রবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু কৃষি ব্যবস্থা আজও সুস্থায়ী হয় নি। পূর্বে আদিম জীবিকা সত্তাভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা থাকায় উৎপাদনের পরিমাণ কম হত। তার পরবর্তী পর্যায়ে বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন ও সবুজ বিপ্লবের হাত ধরে নিবিড় কৃষি ব্যবস্থার আগমন ও কৃষিবিপ্লবের সম্ভাবনা দেখা দিল। নিবিড় কৃষি ব্যবস্থায় ফসলের উৎপাদন বেশি হলেও শীঘ্র বোঝা গেল ব্যায়ের পরিমাণ অনেক বেশি। তার ফলে যা উৎপাদন হত ও তার জন্য যা ব্যয় হত তাতে কৃষি মহল লাভের পরিমাণ খুব কমই পেত। তা ছাড়া কৃষিতে ব্যবহৃত দ্রব্যাদির জন্য জমির উর্বরতাও নষ্ট হচ্ছিল। তাই সুস্থায়ী কৃষি ব্যবস্থার প্রশ্নটি আজ উঠে আসে। কিন্তু বাণিজ্যিক কৃষিকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয় তাতেই দেশের উন্নতির মান কমে যায় ও উন্নয়নশীল দেশ অনুন্নত হয়ে পড়ে। সেজন্য উৎপাদনশীল ও সুস্থায়ী কৃষির প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি করে অনুভূত হচ্ছে। কারণ এটি কৃষি ব্যবস্থার এক নবরূপ যার ভিত্তি চাষের জমির ক্ষতির আশঙ্কা হ্রাস, লোকায়ত চাষবাসের সম্পদ সংরক্ষণশীলতা, সর্বোপরি সুস্থায়ী কৃষি ও আধুনিক প্রযুক্তির চিন্তায় সম্পৃক্ত।
আধুনিক বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশ তাই সুস্থায়ী কৃষির প্রতি আকৃষ্ট। যে কৃষি ব্যবস্থা বর্তমান চাহিদাকে মিটিয়ে ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করতে পারে, তাকেই সুস্থায়ী কৃষি ব্যবস্থা (Sustainable Agricultural System) বলে। এই সংজ্ঞাকে বর্তমানে পৃথিবীর বহু উন্নত, উন্নয়নশীল দেশ মেনে নিয়েছে এবং তারা সে পথই অনুসরণ করছে।