সুস্থায়ী কৃষির প্রয়োজনীয়তা কি? সুস্থায়ী কৃষির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
সুস্থায়ী কৃষির প্রয়োজনীয়তা কি?
ভূমিকা :- সবুজ বিপ্লবের আর্শীবাদে ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থার প্রভূত উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। সবুজ বিপ্লবের হাত ধরে ষোড়শ শতাব্দীতে কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বহুল বৃদ্ধি পায়। অত্যধিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে খাদ্য শস্যের জোগান। বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে এই বিপ্লবের ফলাফল আরও পরিস্ফুট হতে থাকে। কৃষিতে উচ্চ ফলনশীল বীজের বহুল ব্যবহার, রাসায়নিক সারের প্রচলন, উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে লাঙল দেওয়া, বীজবপনের ক্ষেত্রে আধুনিক ব্যবস্থা সর্বোপরি, ফসল তোলার ক্ষেত্রেও প্রভূত উন্নতি দেখা দেয়। এই বিপ্লবের ফলাফল মানুষের জীবনের উন্নয়ন ঘটালেও প্রাকৃতিক নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন করে। উন্নত কীটনাশক, উচ্চফলনশীল বীজের অত্যধিক ব্যবহার জমির বহন ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে যায়, পরিণতি রূপে বর্তমানে সুস্থায়ী কৃষির ধারণার অবতারণা ঘটে।
সুস্থায়ী কৃষির প্রয়োজনীয়তা :-
সুস্থায়ী কৃষি পদ্ধতি প্রধানত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে গঠিত। সেগুলি হল – (ক) বাস্তুতান্ত্রিক উন্নয়ন, (খ) অর্থনৈতিক সুস্থিরতা, (গ) সামাজিক সুস্থিরতা।
(ক) বাস্তুতান্ত্রিক উন্নয়ন :-
বর্তমান খামারগুলি কৃষিক্ষেত্রে বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্যকে মাথায় না রেখে অত্যধিক শস্য উৎপাদনের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে জমির উর্বরতাকে বিনষ্ট করে। তারা বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্যকে বিনষ্ট করে। জমির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে উর্বরতা শক্তি বিনষ্ট হয়, মৃত্তিকা অনুর্বর হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে, সামগ্রিক জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটতে থাকে। সুস্থায়ী কৃষির চিন্তাধারা কৃষিক্ষেত্রে এই সকল সমস্যাগুলির সুষ্ঠু সমাধান করতে সক্ষম হয় এবং বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্যকে বিঘ্নিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করবে। যেমন –
(১) মৃত্তিকার উর্বরতা বৃদ্ধি :- ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থার প্রধান সমস্যা অনুর্বর মৃত্তিকা যা প্রধানত অত্যধিক ফলন, উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যাপক হারে ব্যবহার, রাসায়নিক সার প্রয়োগ ইত্যাদির জন্য হয়ে থাকে। সুস্থায়ী কৃষি এই সকল সমস্যাগুলির সুষ্ঠু সমাধানে সক্ষম।
(২) শস্যাবর্তন :- মৃত্তিকার ক্ষয়রোধ ও উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য একটি নির্দিষ্ট জমিতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শস্যের পর্যায়ক্রমিক উৎপাদনকে শস্যাবর্তন বা চক্রাকার কৃষি বলে। মৃত্তিকার সুস্থিরতা বজায় রেখেই এই পদ্ধতিতে প্রচুর পরিমাণে ফসল উৎপন্ন হয়, জমির গুণগতমান বজায় থাকে, ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যতা বজায় থাকে, রোগজীবাণুর হাত থেকে ফসলকে রক্ষা করা যায়।
(৩) সুস্থায়ী পদ্ধতিতে কীট দমন :- অনেক ক্ষেত্রেই ফসলকে ক্ষতিকারক পোকার আক্রমণ থেকে বাঁচাতে অনিয়ন্ত্রিত হারে কীটনাশক স্প্রে করা হয়, কিন্তু এর ফলে যেমন ফসল আক্রমণকারী পোকার বিনাশ ঘটে তার সঙ্গেই বহু পোকার মৃত্যু ঘটে। যেমন – কিছু বিশেষ প্রজাতির মাকড়সা জাল তৈরি করে বিষাক্ত পোকাকে মেরে ফেলে, লম্বা শুঁড়ের ঘাসফড়িং-এর প্রজাতি বিভিন্ন পোকার ডিম খেয়ে নেয়। এই কারণে কীটদমনের ক্ষেত্রে সুস্থায়ী পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়।
(৪) জল :- বর্তমান কৃষিতে ব্যবহৃত উপাদানগুলি যেমন – সার, কীটনাশক ইত্যাদি ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন হয় অত্যধিক জলের যা শুধুমাত্র জলসেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে সম্ভব হয়। জলসেচ ব্যবস্থা ব্যয়সাপেক্ষ ও জমির উপর চাপ বৃদ্ধিকারী। সুস্থায়ী কৃষি জমির উপরিস্তরের মৃত্তিকায় বৃষ্টির জলধারণ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করতে প্রস্তুত করে যা জলের অভাবমোচন করে ও অতিরিক্ত জলের প্রয়োজনকে মেটাতে সাহায্য করে।
(৫) জীববৈচিত্র্য :- সুস্থায়ী কৃষি নিয়মিত কৃষি পদ্ধতি এবং এতে মিশ্র শস্যের চাষও হয়। এর ফলে কৃষিজমিতে শস্যের পাশাপাশি অন্যান্য উদ্ভিদের জন্ম ও বৈচিত্র্য দেখা যায় এবং নতুন নতুন প্রজাতির কীটপতঙ্গের আগমনের ফলে জীববৈচিত্র্যের সুযোগ হয়।
(৬) দূষণ :- কীটনাশকের অত্যধিক ব্যবহার দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি করে। পরোক্ষভাবে যা মানুষের নানা শারীরিক গোলযোগের সৃষ্টি করে। সুস্থায়ী কৃষি এই সকল রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং প্রাকৃতিক সারের ও উন্নত কীটনাশকের ব্যবহার করে জমির দূষণকে নিয়ন্ত্রণ করে।
(৭) ভূমিরূপ :- গ্রামের পরিবেশ কৃষি ও বনাঞ্চল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং ভূমিভাগ শস্য দ্বারা আবৃত থাকে। জমির অধিক ব্যবহার ভূমিধ্বস ও বন্যার সৃষ্টি করতে পারে যা মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী করে তোলে। পরোক্ষভাবে কর্মসন্ধানে সেই সকল মানুষ শহরাঞ্চলে প্রবেশ করে ও শহরাঞ্চলে কর্মের সন্ধানে বসতি স্থাপন করে, স্বল্প পরিসরে বসবাসের ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ধ্বংসসাধিত গ্রামাঞ্চলগুলির উন্নয়নের জন্য অর্থ ব্যয় হয় এবং তা পুনরায় বসবাসের উপযোগী করে তুলতে অনেক সময় লাগে। সুস্থায়ী কৃষি উপরোক্ত সমস্যাগুলি থেকে রক্ষা করে উৎপাদন বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে মৃত্তিকা সংরক্ষণ করে এবং সঠিক পদ্ধতিতে চাষ-আবাদ করে। যার ফলে শহরাঞ্চলে মানুষকে কর্মসন্ধানে আসতে হয় না।
(৮) জলবায়ুকে রক্ষা করা :- অনিয়ন্ত্রিত এই কৃষি ব্যবস্থা সমগ্র বিশ্বের জলবায়ুর পরিবর্তন করতে পারে। কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন ঘটে এবং পরিমাণকে বৃদ্ধি করে। উদ্ভিদের কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণের পরিমাণকে কমিয়ে দেয়। সুস্থায়ী কৃষির সাহায্যে উক্ত সমস্যাগুলির সঠিক সমাধান করা সম্ভব হয়।
(৯) জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে উচ্চ ফসলশীল বীজবপন :- বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবীর গড় উষ্ণতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এর ফলে খরা একটি নিত্য জলবায়ুগত সমস্যায় পরিণত হয়েছে। ফল স্বরূপ সুস্থায়ী কৃষি ব্যবস্থার মাধ্যমে খরা সহ্যকারী বিভিন্ন উচ্চ ফলনশীল বীজের উদ্ভাবন করা হচ্ছে। যেমন ভারতে খরাসহ্যকারী ‘কিরণ’ ও ‘কারন’ নামে দুই প্রকার ধানের উদ্ভব হয়েছে।
(খ) অর্থনৈতিক সুস্থিরতা :-
- (১) মানুষের অভ্যন্তরীণ চাহিদার কথা মাথায় রেখে শুধুমাত্র উদ্বৃত্তের তাগিদে বর্তমানে সরকারও কৃষিকার্য করতে বাধ্য করে। উদ্বৃত্ত বিদেশে বিক্রি করে অতিরিক্ত মুনাফা লাভ তাদের উদ্দেশ্য, এই অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের উদ্দেশ্যে প্রযুক্তি নির্ভর কৃষিতে সরকারও উৎসাহ দান করে, সরকারি ঋণদানের মাধ্যমে চাষিদের মুনাফা মাটিতে শস্য উৎপাদনে উৎসাহিত করে তোলে। পরিণতিরূপে সঠিক সময়ে ঋণের অর্থ ফেরত না দিতে পেরে চাষিরা আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
- (২) জৈব কৃষি ব্যবস্থা সাধারণ কৃষি ব্যবস্থার তুলনায় অনেক বেশি উন্নত এবং নিয়ন্ত্রিত। তাই জৈব উপায়ে সুস্থায়ী পদ্ধতির কৃষিকাজ করা একান্ত প্রয়োজন।
- (৩) কৃষিকাজ একটি প্রাথমিক কর্ম যা গ্রামাঞ্চলের নারী, পুরুষেরা সম্পাদন করে থাকে। একটি জমিকে চাষ করতে যে কয়জন ব্যক্তির প্রয়োজন হয় তার চেয়ে বেশি মানুষ উক্ত জমিতে কাজ করে, তার ফলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত মানুষের সমাবেশ কৃষিক্ষেত্রে দেখা যায়, যারা প্রকৃতপক্ষে ছদ্মবেশী বেকাররূপে বিবেচিত হয়। এজন্য কর্মক্ষম ব্যক্তির গণনার ক্ষেত্রে একটি সমস্যার সৃষ্টি হয়।
(গ) সামাজিক সুস্থিরতা :-
- (১) সুস্থায়ী কৃষি ব্যবস্থায় কৃষিতে নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গের কর্মসংস্থান হয় এবং যার ফলে গ্রামাঞ্চলে মহিলা, পুরুষ উভয়ে কর্মমুখী হয়ে ওঠে।
- (২) সুস্থায়ী কৃষি জাতি উপজাতির আদিম সত্তাকে বহাল রাখে। তাদের নিজস্ব কৃষি পদ্ধতির বিরোধিতা না করে এই কৃষি ব্যবস্থা হওয়ায় বিভিন্ন জাতির অভ্যন্তরীণ শ্রদ্ধা অব্যাহত থাকে। তারা তাদের প্রাচীন বিধিনিষেধকে বজায় রেখে কৃষিকার্য করতে পারে।
- (৩) সুস্থায়ী কৃষি ব্যবস্থা কৃষির প্রাচীনত্বকে ভঙ্গ করে নতুন ও আধুনিকতাকে বজায় রাখে। এর ফলে পুরুষ, মহিলা, উচ্চ-নীচ সকলে একত্রে কাজ করায় মেলামেশার সুযোগ অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
- (৪) জমির উর্বরতাকে সক্ষম রেখে, জনসংখ্যার প্রয়োজনকে সম্পূর্ণ করে এই কৃষি ব্যবস্থা চালু হয়েছে ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এবং মানুষের মেলামেশার বৃদ্ধি হওয়ায় সংস্কৃতির আদানপ্রদান ও কৃষিক্ষেত্রে নতুনত্বের সম্ভাবনা বেড়েছে।
উপসংহার :-
প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রজাতি বৈচিত্র্যের স্থায়িত্ব কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সারা বিশ্বের প্রয়োজন মেটানোর জন্য অধিক ফলন অবশ্যকর্তব্য কিন্তু বিশ্ব প্রকৃতির অবনমন ঘটিয়ে তা করা যুক্তিসংগত হওয়া উচিত নয়।